সোহিনী রায়
এই মুহূর্তে প্রায় দুনিয়া জোড়া লকডাউন চলছে। পৃথিবীর সাতাশ-আটাশটা দেশে মানুষের গতিবিধির ওপর কোনো না কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। খবরে প্রকাশ এই অবস্থার ফলে নথিভুক্ত গৃহ-হিংসার পরিমাণ তুমুল বেড়ে গিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সামনের সারির পত্রিকাতেই এই বিষয় লেখা বেরিয়েছে। ফ্রান্সের মোট গৃহ হিংসা লকডাউনের পর বেড়েছে ৩২ শতাংশ । দুজন মৃত। ফ্রান্সে ২০ টা আলাদা কেন্দ্র খুলতে হয়ছে যেখানে নির্যাতিত দোকান-বাজার করার নামে বেরিয়ে সাহায্য চাইতে পারবে। ফ্রান্স-এর সরকার নির্যাতিতদের আলাদা করে হোটেলে রাখার ব্যবস্থাও করেছেন। সরকার খরচাপাতির দায়িত্ব নিয়েছে। চিন জানিয়েছে উহানে আগের থেকে তিনগুন ঘটনা নথিভুক্ত হচ্ছে এখন । ইটালি আর ইউ কে সম্ভবত নির্যাতনকারীকে ঘর থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। কিছু দেশ মনে করছে ঘরে ঘরে গিয়ে ঘরের বাচ্চাদের অবস্থা খতিয়ে দেখবে । স্পেন প্রাথমিকভাবে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছিলো না। একটি মেয়ে খুন হওয়ার পর টনক নড়ে। ভারতে লকডাউনের পর জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছে অভিযোগের সংখ্যা মার্চ মাসের শুরুর সপ্তাহের তুলনায় শেষ সপ্তাহে প্রায় দু-গুণ হয়ে গিয়েছে।
এই নির্যাতনের চেহারা কীরকম? নানারকম। কোথাও সুরক্ষার নামে সঙ্গীকে ঘর থেকে একেবারেই বেরোতে না দেওয়া। একটি জায়গায় নির্যাতিত বলেছেন যে, তার সঙ্গী তাকে বন্দুক ও হাতুড়ি দেখিয়ে গৃহবন্দী রেখেছেন। নির্যাতক এরকমভাবে নির্যাতিতকে তার কাছে আটকে রেখেছেন। কোথাও নির্যাতক তার সঙ্গীকে ক্রমাগত মেরে চলেছেন ও অসম্মানজনক কথা বলে চলেছেন। কোথাও নির্যাতক তার সঙ্গীকে বলছেন যে, কাশলেই তিনি তাকে ঘর থেকে বের করে দেবেন। কোথাও নির্যাতক হাত ধোয়ার বিভিন্ন সামগ্রী লুকিয়ে রাখছেন নির্যাতিতর কাছ থেকে। একটি বয়ানে দেখা যাচ্ছে যে, ব্যবসায়ী স্বামী তার ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এ ব্যস্ত স্ত্রী-র ওপর চরম নির্যাতন করছেন, মোবাইল ভেঙ্গে দিচ্ছেন, মার-ধোর করছেন । এরই মধ্যে যে, নির্যাতিতরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তাদের অবস্থা সবচাইতে খারাপ। একজন নির্যাতিত জানিয়েছেন যে, সকালে ঘুম থেকে উঠে তার গা গরম দেখেই তার সঙ্গী তাকে ঘর থেকে বাইরে বের করে দিয়েছেন।
কেন বাড়ছে নির্যাতন? প্রাথমিকভাবে শোনা গেছিলো যে, ঘরে থেকে পুরুষরা ( যদিও আমেরিকায় মহিলার দ্বারা নির্যাতনও নথিভুক্ত হয়েছে, সংখ্যায় খুবই কম অবশ্য।) হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে যাদের জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে এই লকডাইনে তারা খুব বেশিমাত্রায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এমনকী কিছু ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের কণ্ঠেও এইধরনের মন্তব্য শোনা গিয়েছিলো। এই ধরনের মন্তব্যের বিরোধিতাও শোনা যায় প্রায় সাথে সাথেই। আমেরিকার তথ্য বলছে যে, মেয়েদের মধ্যেও একটি বিরাট অংশ কাজ হারানোর আশঙ্কায় ভুগছেন। সেক্ষেত্রে কি ঘটছে এইধরনের নির্যাতন মেয়েটির দ্বারা ? যদি না ঘটে থাকে তার মানে ‘ঘরোয়া হিংসা বেড়ে যাওয়ার কারণ পুরুষের হতাশা’- এটা কি খুবই সরলীকৃত ব্যাখ্যা নয়? ৫ই এপ্রিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনেরাল জানিয়েছেন যে, ঘরোয়া হিংসার কোনো অজুহাত হয় না, এই বাড়তে থাকা হিংসা সামলানোর দায়িত্ব প্রতিটি দেশ নিক ও নির্যাতিতকে সঠিক সুরক্ষা দিক।
ঠিক এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে মনে হলো যে, সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া গৃহ-হিংসা বিষয়ক একটি বই-এর ভালোদিক ও খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। বইটির নাম ‘খাদের ধারে ঘর’। বইটির সম্পাদনা করেছেন শতাব্দী দাস। ‘৯রিকাল বুকস’-এর পক্ষ থেকে সামরান হুদা এই বইটি প্রকাশ করেছেন।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, এরকম একটি বই হাতে পেয়ে খুবই আনন্দ পেয়েছি। তার কারণ গৃহ-হিংসা বিষয়ক বহু লেখা-পত্র, বই আন্তর্জালে পাওয়া যায়। কিন্তু সবই ইংরিজি ভাষায়। পড়তে গেলে ধাক্কা লাগে। পড়ে ঠিক পুরো আরাম পাওয়া যায় না। বাংলা ভাষায় এধরনের বই আমি অন্তত এখনও পর্যন্ত দেখিনি। ফলে এই বই-এর উদ্যোক্তাদের বিশেষ অভিনন্দন প্রাপ্য। গৃহ-হিংসা বিষয়ক আইনি, প্রচারমূলক অনেক চটি বাংলা বই হাতে এসেছে । কিন্তু সেগুলো নেহাতই প্রচার-পত্র। বই নয়।
বইটিতে গৃহ-হিংসাকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখা হয়েছে। লেখাগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমভাগে, গৃহ-হিংসার তাত্ত্বিক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয়ভাগে, বেশ কয়েকজন নির্যাতিতর বয়ান রাখা হয়েছে। তৃতীয়ভাগের লেখাগুলোয় গৃহ-হিংসা কীভাবে প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। শেষভাগে এইধরনের পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এবং বেরিয়ে আসার পর নির্যাতিতকে কী কী মনে রাখতে হবে সেইটা আলোচনা করা হয়েছে। এই অংশটির নাম ‘আমার শপথ’।
এই বইটিতে গৃহ-হিংসাকে, এ বিষয়ে নিছকই কিছু আইনি পরামর্শের বাইরে বের করে এনে বাস্তবের মাটিতে স্থাপন করা হয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটি। চালু ধারণা হলো যে, মূলত পণের জন্য মেয়েরা মার খায়। মরে গেলে কাগজে খবর হয়। চালু ধারণা হলো যে, গৃহ-হিংসা মানে মূলত মারধোর। চালু ধারণা হলো যে, গৃহ-হিংসা মূলত গরীব ঘরে হয়। বস্তুত ঘরোয়া হিংসা (Domestic Violence) বা ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর দ্বারা হিংসা (Intimate Partner Violence) অত্যন্ত জটিল একটি ব্যাপার। বইটিতে সেই জটিলতাটাকে ধরার চেষ্টা চালানো হয়েছে। এখানেই বইটির বৈশিষ্ট্য ও স্বার্থকতা। বইটির অধিকাংশ লেখার ভাষা খুবই সাবলীল। ফলে সহজেই বিষয়ে ঢুকে পড়া যায়। অধিকাংশ লেখায় এক ধরনের প্রসাদগুণ আছে। ফলে বইটি যে কোনো উৎসাহী ব্যক্তিই পড়তে পারবেন। যার কাজে লাগার তার কাজে লাগবে।
বইটিতে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সেগুলো কী কী?
১। একাধিক মানুষ একসাথে থাকতে গেলে মতের অমিল হতেই পারে। তাই নিয়ে খটাখটি, ঝগড়া, মান-অভিমান ইত্যাদিও হতে পারে। এগুলো কোনোটাই গৃহ-হিংসা নয়।
২। গৃহ-হিংসা একটি নির্দিষ্ট ব্যবহার। এখানে একজন সঙ্গী আর একজন সঙ্গীকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালায় , ভয় দেখিয়ে, শাসিয়ে, আবেগ দিয়ে, আধাত্মিকভাবে, শারীরিক, যৌন ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে। মূলত সঙ্গীর শরীর, মনকে দখল করার মানসিকতা থেকে এই ধরনের ব্যবহার করা হয়।
৩। গৃহ-হিংসা সমাজের যে কোনো স্তরে হতে পারে। যে কোনো লিঙ্গের মানুষের মধ্যে হতে পারে।
৪। ঘনিষ্ঠ সঙ্গীকে মারধোর করা যেমন হিংসা, তেমনই মারধোর না করেও হিংসাত্মক আচরণ করা যায়। ক্রমাগত অপমানজনক কথা বলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলা, গালাগাল দেওয়া, প্রচণ্ড সমালোচনা করা ইত্যাদি সবই গৃহ-হিংসার আওতায় পড়ে। এগুলোকে মানসিক নির্যাতন বলা হয়। ঘরোয়া নির্যাতনের ক্ষেত্রে মানসিক নির্যাতনের প্রভাব মারাত্মক হয়। যেখানে শারীরিক নির্যাতন চলে সেখানে, শারীরিক নির্যাতন যখন বন্ধ থাকে তখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসিক নির্যাতন চলতে থাকে। মানসিক নির্যাতনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব থাকে। বিশেষজ্ঞের সাহায্য ছাড়া এর প্রভাব কাটিয়ে ওঠা মুশকিল হয়ে ওঠে।
৫। এইধরনের ব্যবহার হঠাৎ করেই করে ফেলা কোনো আচরণ নয়। কোনো মানসিক অসুস্থতা নয়। রাগ-নিয়ন্ত্রণ না করে উঠতে পারার সমস্যা নয়। দীর্ঘদিন এরকমই কিছু মনে করা হয়েছিলো। দীর্ঘদিনের কাউন্সেলিং, এংগার ম্যানেজমেন্টের প্রোগ্রাম, কাপল কাউন্সেলিং ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরও দেখা গিয়েছে নির্যাতকের মূল চরিত্র অপরিবর্তিত থাকে। এই ধরনের ব্যবহার নির্বাচিত ব্যবহার। মানে নির্যাতকের সামনে অনেকধরনের ব্যবহারের সুযোগ থাকে। কিন্তু সে হিংসাত্মক ব্যবহারই করে এবং সব জায়গায় করে না। যেমন, এই মুহূর্তে, এই লকডাউনের সময় যারা নির্যাতন করছে তাদের হতাশা আছে ধরে নেওয়া যেতে পারে তর্কের খাতিরে । কিন্তু হতাশ হয়ে তারা অনেকরকম ব্যবহারই করতে পারত। হতাশা সঙ্গীর সাথে ভাগ করে নিতে পারত। নিজের বিপন্নতার কথা সঙ্গীকে বলে হাল্কা হতে পারত। দুজনে একসাথে কঠিন সময় যোঝবার জন্য তৈরি হতে পারত ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো কোনোটাই করল না। সঙ্গীর ওপর অত্যাচার করল। মানে একটা নির্দিষ্ট ধরনকে বেছে নেওয়া হল। নির্বাচন করে নেওয়া হল একটি নির্দিষ ব্যবহারকে।
৬। এই নির্দিষ্ট ধরনের ব্যবহার চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্যাতকরা ম্যানিপুলেটিভ হয়।
৭। সবসময়েই কি এই ধরনের সম্পর্কে নির্যাতন থাকে? না থাকে না। নির্যাতন-ভালো ব্যবহার-ক্রমশ বাড়তে থাকা টেনশন-সাংঘাতিক হিংসা-তারপর আবার ভালো ব্যবহার-এই রকম একটা চক্রের মধ্যে ঘুরতে থাকে সম্পর্ক। নির্যাতক নিজের হিংসাত্মক ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চায়, কিন্তু সে সবসময়েই নিজের ব্যবহারকে লঘু করে, এবং তার এই ব্যবহারের কারণ হিসেবে অন্য কিছুকে দায়ী করে, নির্যাতিত কে দায়ী করে। এবং সে আবারও একইরকম ব্যবহার করে। তবে এই চক্রেরও কিছু সমালোচনা আছে। অনেক্ষেত্রেই শুধুই নির্যাতন চলতে থাকে টানা। ভালো ব্যবহারের কোনো পর্যায় তৈরি হয় না।
৮। দীর্ঘদিন এই ধরনের পরিবেশে থাকার ফলে নির্যাতিতর মনের ওপর প্রবল ছাপ পড়ে। আত্মবিশ্বাসের প্রবল অভাব তৈরি হয়। সে নিজের এই দূরবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী করতে থাকে। একধরনের অসহায়তার বোধ তার মধ্যে ঢুকে যায়। তার নির্যাতনের মধ্যেই থাকাটা অভ্যেসে পরিণত হয়। নির্যাতকের সাথে তার একধরনের বন্ধন তৈরি হয়ে যায়। নির্যাতনের বন্ধন। ফলে সহজে বেরোতে পারে না সে এই পরিবেশ থেকে। নির্যাতকের ব্যবহারকে সমর্থন করতে থাকে। বার বার ফিরে যায় তার নির্যাতকের কাছে, শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসার আগে। অনেকেই বেরোতে পারে না সারা জীবনেও।
৯। এই ধরনের পরিবেশে বেড়ে উঠতে থাকা শিশুদের ওপরও সাংঘাতিক প্রভাব পড়ে। শিশুদের তাই ‘লুকোনো নির্যাতিত’ বা ‘হিডেন ভিক্টিম’ বলা হয়।
এছাড়াও আরো বহু কিছু এই বইতে বলা হয়েছে। কিন্তু মূল জোর দেওয়া হয়েছে এগুলোর ওপরই।
বইটিতে ইন্দিরা চক্রবর্তীর বেশ কয়েকটি লেখা আছে। ইন্দিরা চক্রবর্তী এ বিষয়ের দীর্ঘদিনের অগ্রনী কর্মী। প্রত্যেকটি লেখা স্বীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ । গৃহ-হিংসার স্বরূপ, তার সংখ্যাতত্ত্ব, কেন নির্যাতিত বেরোতে পারে না নির্যাতনের পরিমণ্ডল থেকে, নির্যাতিতর চরিত্র, নির্যাতকের চরিত্র ইত্যাদি নানা বিষয় তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। একটা লেখা যেখানে শেষ হচ্ছে, পরের লেখাটি সেখান থেকেই শুরু হচ্ছে। সবকটি লেখাকে একসাথে করে একটি ছোট পুস্তিকার আকারেও পরবর্তীকালে প্রকাশ করার কথা ভাবা যেতে পারে।
নির্যাতিতর মনজগত নিয়ে কৌশিক দত্তর লেখাটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। সহজ ভাষায় সহজভাবে লেখা। কী লেখা হয়েছে প্রায় পুরোটাই মাথায় থেকে যায়।
মানসিক নির্যাতন নিয়ে রায়া দেবনাথের লেখাটিও আলাদা করে বলতেই হয়। নানাকারণে মানসিক নির্যাতন সাধারণভাবেই গুরুত্ব বেশি পেয়ে ওঠে না। মানসিকভাবে নির্যাতিতদের একটা পরিমাণ যত্নের দরকার পড়ে। লেখায় সেই যত্নের ছাপ রয়েছে।
শতাব্দী দাস-এর ৪৯৮-এ আইন নিয়ে লেখাটি তথ্যবহুল। গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয়েছে লেখাটি আরো খানিকটা বিশ্লেষনাত্মক হলে ভালো হতো। রাষ্ট্র এই আইনটি পরিবর্তন করতে চায়। কিন্তু কেন চায় তার কোনো ব্যাখ্যা শতাব্দীর লেখাতে ছিলো না। লেখাটির স্বয়ং-সম্পূর্ণতার জন্যই এই ধরনের বিশ্লেষণ লেখাটিতে থাকা দরকার ছিলো।
পারিবারিক নির্যাতনের গল্প হিসেবে কবিতা সিংহ-র গল্পের ব্যবহার অভিনব ও প্রশংসনীয়। অদিতি বসু রায়-এর লেখাটি বেশ ভালো। ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে মানসিক নির্যাতন বোঝানোর জন্য একটি নতুন শব্দ-বন্ধ উনি ব্যবহার করেছেন-‘অন্তর-টিপুনি’ । চমৎকার লেগেছে।
বইটির অলংকরণ ময়াঙ্ক রাই-এর। ছবিগুলো বিশেষভাবে আকর্ষণ করে।
‘আমার শপথ’ অংশটি ইন্দিরা চক্রবর্তীর লেখা। খুব ভালো লেখা। খুব কাজের।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ বিষয়ক লেখাগুলো অনেক দিকই ধরেছে। যারা নানারকম সাংঠনিক স্তরে, এনজিও স্তরে সাহায্য করে তাদের অভিজ্ঞতার বয়ান রয়েছে। খুবই উপকারী একটা অংশ। যারা সাহায্য চাইছেন তারা এই অংশটি পড়ে বুঝতে পারবেন যে, তাদের কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। কেন গৃহ-হিংসা বিষয়ক মামলা চালানো, তাতে অভিযুক্ত সাব্যস্ত হওয়া কঠিন এবং প্রায় অসম্ভব একটি কাজ –তার একটা পরিমাণ ব্যাখ্যাও এখানে আছে। তবে কিছু দিক একদম অনুহ্য থেকে গিয়েছে। যেমন, কেন এই ধরনের গৃহ-হিংসা বিষয়ক মামলা-মোকদ্দমাগুলো করা হয় ? কেন মেয়েরা এইদিকে বাধ্য হয় ধাবিত হতে ? অধিকাংশ লেখায় একধরনের হাহাকার ফুটে ওঠে ‘শাস্তি হয় না, শাস্তি হয় না’। প্রাথমিকভাবে শাস্তি চেয়ে কি এই মামলাগুলো করা হয় নাকি মেয়েরা নিজেরা বাঁচতে চেয়ে এই মামলাগুলো করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে? বাধ্য হয় করতে? একবার বেঁচে বেরিয়ে আসতে পারলে শাস্তি দেওয়ার এই দীর্ঘসূত্রী প্রক্রিয়ায় থেকে যাওয়াটা কি যথেষ্ট কষ্টকর নয়?
আরও একটি দিক একদম বাদ চলে গিয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। বার বারই মেয়েটির সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের বিবাহ-বিচ্ছেদের আইন নিয়ে কোনো আলোচনা এখানে উঠে আসেনি। অন্তত আমার চোখে পড়েনি। এলেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আমি মনে করি সেটা দেওয়া উচিৎ ছিলো। আমাদের দেশে ‘কোনো কারণ ছাড়া বিচ্ছেদ’ বা ‘নো ফল্ট ডিভোর্স’-এর কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ আমাদের দেশে দুজন মানুষের বনিবনা হচ্ছে না বলে কোনো এক পক্ষ ডিভোর্স নিয়ে নিতে পারে না যদি আর এক পক্ষ ডিভোর্স দিতে না চায়। ডিভোর্স বা বিচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কারণ দেখাতে হয়। সঙ্গী অত্যাচারি, ব্যাভিচারি ইত্যাদি এবং সেগুলো সবকটাকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। মেয়েটি যেখানে অত্যাচারিত সেখানেও সে বিচ্ছেদ পায় না সহজে। জনমানসে এরকম একটা ধারণা আছে যে, ৪৯৮-এ তে মামলা চলছে মানেই বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। ৪৯৮-এ বিচ্ছেদ উপহার দেয় না, দেওয়ার কথাও নয়। বিচ্ছেদের আলাদা মামলা চলে। ৪৯৮-এ তে মামলা চলছে বলে বিচ্ছেদ সহজ হয়ে যায় এরকমটাও নয়। এই ধরনের ক্ষেত্রে দেখেছি যে, এই ৪৯৮-এ আইনের মামলাগুলো প্রায় বিক্রি করা হয়। অর্থাৎ এই মামলাগুলো আর টেনে নিয়ে না যাওয়ার শর্তে মেয়েটি ডিভোর্স পায়। এই কেসগুলো তখন সম্ভবত সেল্ভড কেসে পরিণত হয়। এই কেসগুলোই সম্ভবত ৪৯৮-এর আওতায় থাকা ‘ভুয়ো কেস’ বা ‘ফলস কেস’-এর সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ধরনের ঘটনার ইঙ্গিত এই লেখাটিতে ছিলো। কিন্তু আসল জায়গায় ধাক্কাটা মারা হয়নি। মেয়েরা নিজেরাই এই কেনাবেচায় অংশ নেয়। নিতে বাধ্য হয়। পরিবর্তে সে ডিভোর্স পায়। নিজের নির্যাতকের হাত থেকে সারাজীবনের জন্য মুক্তি পায়। নিজের মতো বাঁচে। তার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এইটা খুবই জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। বদলে সে বিক্রি করে নিজের নির্যাতককে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ। বইটিতে যারা লিখেছেন তারা নিশ্চিতভাবেই এগুলো সব জানেন । কিন্তু কোনো কারণে এই আলোচনাটা উঠে আসেনি কোনো লেখায়। ‘নো ফল্ট ডিভোর্স’-এর দাবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দাবি। এটাকে সমর্থন না করলেও বিচ্ছেদের আইন নিয়ে একটা আলোচনার দরকার ছিলো।
বইটিতে কিছু অনুবাদ আছে। অনুবাদের বিষয় আরো একটু যত্নবান হওয়া দরকার ছিলো। বইটিতে একই কথা বহু লেখায় বার বার চলে এসেছে। একই লেখকের একাধিক লেখা বইটিতে রয়েছে। এটা একটু দৃষ্টিকটু লাগে। সম্ভবত একই লেখক একাধিক লেখা লিখেছেন বলেই কিছু কথা বইটিতে ঘুরে ঘুরে চলে এসেছে। পাঠককে বোঝানোর জন্য হয়তো সেটা কখনও কখনও দরকার পড়ে। তাও একটু কাট-ছাঁট করা হলে হয়তো ভালো হত। কিছু লেখায় কিছু সংখ্যাতত্ত্ব দেওয়া হয়েছে যেগুলোর মানে বুঝতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। সেই দিকগুলোতেও নজর দেওয়া দরকার।
বইটিতে প্রথমেই বলে নেওয়া হয় যে, গৃহ-হিংসার মোট শিকারের ৮৫-৯৫ শতাংশ মহিলা। ফলে বইটিতে নির্যাতিতকে মহিলাই ধরে নেওয়া হবে। সব লেখাতেই এটা করা যেতে পারে-তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু একটা অন্তত লেখা থাকলে ভালো হতো এই পুরুষ নির্যাতিতদের বিষয়টা নিয়ে। বিশেষ করে যেখানে নারী নির্যাতক সেখানকার বিষয়টা নিয়ে। কারণ এখানে যে তত্ত্বগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলোর সবকটাতেই সমাজে বহু যুগ ধরে চলে আসা পুরুষের বিশেষ অবস্থান পুরুষকে নির্যাতক হয়ে ওঠার দিকে ঠেলে দেয় বলে দেখানো হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় নারীরা কীভাবে নির্যাতক হয়ে উঠছেন ? অন্তত একবার একটু কোথাও আলোচনার দরকার ছিলো বলেই মনে হয়।
ঠিক এই জায়গা থেকেই বইটিকে ঘিরে আমার শেষ সমালোচনা। গৃহ-হিংসা একধরনের হিংসা। ফলে গৃহ নিরপেক্ষভাবে হিংসা নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনার দরকার ছিলো বলে মনে হয়েছে। অর্থাৎ হিংসার, কেবলমাত্র হিংসার কী কোনো সামাজিক ন্যায্যতা আছে ? বিশেষত কর্তৃপক্ষীয় হিংসার? মানে রাষ্ট্রের হিংসার, মিলিটারির হিংসার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের হিংসার কী গ্রহণযোগ্যতা আছে? মিলিটারির অন্য দেশ আক্রমণ করা, পুলিশের লাঠি পেটানো, মৃত্যুদণ্ড, স্কুলে শিক্ষকের শাস্তি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কি হিংসাত্মক শাস্তি দেওয়ার একটা পরিমাণ ন্যায্যতা তৈরি হচ্ছে না? যেই গ্রহণযোগ্যতা আসলে একজন হিংসাত্মক পুরুষের হিংসা করার একধরনের আত্মপক্ষ সমর্থন তৈরি করে ? বইটিতে একাধিকবার বলা হয়েছে যে, নির্যাতক আসলে নির্যাতিতকে শাস্তি দেয়। শাস্তি কে দিতে পারে ? কর্তৃপক্ষই দেয়। যেখানে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে হিংসা হচ্ছে সেখানে দু-জন দুজনের সহচর নয়। একজন কর্তৃপক্ষ, অন্যজন অধঃস্তন। বৃহত্তর কর্তৃপক্ষের হিংসার সাথে এর কি কোনো যোগ আছে? আমার মনে হয়েছে যে, এই আলোচনাটি একদম অনুপস্থিত বইটিতে। আমার মনে হয়েছে যে, এই আলোচনার দরকার ছিলো। আবারও ফিরে যাই শুরুর কথায়। আজ পৃথিবী জুড়ে লকডাউনের আবহাওয়ায় গৃহ-হিংসার নথিভুক্তিকরণ বাড়ছে। কোথাও দুগুণ, কোথাও তিনগুন। যেগুলো নথিভুক্ত হচ্ছে সেগুলোতে আচমকা এখন হিংসার ঘটনা ঘটছে এরকমটা নয়। আগেও ঘটত। এখন নথিভুক্ত হচ্ছে মাত্র। অনেক নির্যাতিতর বয়ানেই দেখা যাচ্ছে যে, আগে বাপের বাড়ি বা অন্য কোথাও গিয়ে একটু হাঁপ নেওয়ার সুযোগ ছিলো, এখন এই লকডাউন পর্বে নির্যাতকের সাথে এক্কেবারে গৃহ-বন্দী হয়ে যেতে হয়েছে। ফলে নির্যাতন মাত্রাছাড়া হয়ে গিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী মোটের ওপর পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় প্রতি তিন জনে একজন মহিলা গৃহ-হিংসার শিকার, ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার। বইটিতেই রয়েছে এই তথ্য। তার মানে কী বিরাট একটি অংশ অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন যাপন করেন! কোথাও বলতে পারেন না। বেরোতেও পারেন না এই অন্ধকার থেকে। তাদের বাইরে থেকে দেখলে সবসময় বোঝারও উপায় থাকে না যে, তারা এই সমস্যায় রয়েছেন। যদিও বইটি সবারই পড়তে ভালো লাগার কথা তবুও মনে করি এই ধরনের মানুষদের বিশেষ কাজে আসবে বইটি। কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও তাই মনে করি কাজটি অত্যন্ত ভালো কাজ। বইটির সাথে জড়িত সবাইকে আরো একবার অভিনন্দন জানাই।
গৃহ হিংসা বিষয়ক বইটির সমালোচনা প্রসঙ্গে সোহিনী রায় তার আলোচনৈর প্রেক্তিতে শেষে যেকটি সৃত্র নির্দেশ করেছেন সেটি বর্তমান লকডাউন পরিবেশের নিরিখে প্রাসঙ্গিক।বইটি পড়ার ইচ্ছে রইল।